মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

শুভ জন্মদিন : আহাদ আলী মোল্লা

১৮ অক্টোবর। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ঘাবড়ে গেল কাব্য। ডাইনিং রুমে চেয়ার টেবিল একটাও নেই। এখানকার বাসনকোসনও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মা খুবই ব্যস্ত। ঘরদোর সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। মনে হচ্ছে বাড়িতে যেন কিছু একটা হবে। বড় আয়োজন। কিন্তু কিসের আয়োজন? বারবার প্রশ্ন করেও কাব্য উত্তর পায় না। আম্মু বললেন ‘এসব তোর আব্বু জানে।’ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ১০ মিনিট সময় লাগে কাব্য’র। পায়ে হেঁটেই যাওয়া-আসা করে সে। ফেরার পর খানিকটা ঘেমে যায়। তাই ঘাড় থেকে বইয়ের ব্যাগটা নামিয়েই ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে দেয় সে। গা জুড়িয়ে গেলে পড়ার রুমে ঢোকে। কিন্তু আজ রুটিনে মিলল না। ডাইনিং রুমটা ফাঁকা দেখে তার চোখে-মুখে কৌতূহল! বারবার ভাবছে বাড়িতে কী হচ্ছে? কাব্য এইবার একটা উত্তর খুঁজে পেল। হয়তো মেহমান আসবে। কিন্তু তাতে ডাইনিং রুম ফাঁকা হবে কেন? আত্মীয়-স্বজন এলে ওগুলোর তো বেশি দরকার। তবে কি বাড়িতে রঙমিস্ত্রি লাগানো হবে? নানা প্রশ্নে আম্মু তিক্ত-বিরক্ত। রেগে উঠে আম্মু বললেন, ‘ওসব তোর আব্বুকেই জিজ্ঞেস করিস। সে ছাড়া আজকের খবর কেউ জানে না। আমিও বারবার প্রশ্ন করেছি; কিন্তু সে তা বলতে নারাজ। আমাকে ঘর গোছাতে বলেছে, আমি তাই করছি।’ আব্বু কোথায়? আম্মুকে প্রশ্ন করে কাব্য। কেনাকাটা করতে বাজারে গিয়েছে। সোজি কই? সেও তোর আব্বুর সঙ্গে। প্রশ্নের পর প্রশ্নে আম্মু অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। আব্বু না ফেরা পর্যন্ত কৌতূহল কাটছে না কাব্য’র। ‘যাকগে আব্বু এলেই সব জানব। এখন খেতে দাও।’ আম্মু ভাত বেড়ে দিলে কাব্য রান্নাঘরে খেতে বসে। কাব্য চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। বেশ মেধাবী। কিন্তু আজকের রহস্যের জট খুলতে তার মেধায় কুলোচ্ছে না। দুপুরের খাওয়া শেষ করে উঠতেই দরজায় কলিংবেল বাজে। নিশ্চয় আব্বু। এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। হ্যা, আব্বু আর সোজি। সোজির হাতে বেলুনের বাক্স আর মোমবাতি। আব্বুর হাতে বড় একটা কেকের কার্টন, চার প্যাকেট রসগোল্লা। আর জন্মদিনের ঘর সাজাতে যা যা লাগে সব। কাব্য প্রশ্ন করার আগেই সব উত্তর পেয়ে যায়। আজ জন্মদিনের জন্য বাড়ি সাজানো হচ্ছে। কিন্তু কার জন্মদিন, আব্বুর? কই না তো। আম্মুর? না, তাও তো নয়। দাদা-দাদির? উহু তাও নয়। এখন অক্টোবর। সোজির জন্মদিন নভেম্বরে। আমার তো ৪দিন আগেই হয়ে গেল। না হিসাবে মিলল না। কাব্য’র কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। আব্বু ডাইনিংরুমে বসে রঙবেরঙের কাগজপত্র কাটাকাটি করছিলেন। কাব্য জানতে চাইল আজ কার জন্মদিন আব্বু? আব্বু কাব্য’র দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। কোনো জবাব না দিয়ে বললেন- ‘সন্ধ্যায় জানতে পারবে। এখানে সব লেখা আছে।’ এই বলে একটা মোড়ানো কাগজ দেখালেন আব্বু। বললেন এটা এখন খোলা যাবে না। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে ডাইনিং রুমটি সাজালেন আব্বু। রঙিন কাগজ, বেলুন আর জরিতে ঝলমল করছে পুরো রুম। মোড়ানো সেই কাগজটি দেয়ালের একটা জায়গায় সেঁটে দিয়েছেন আব্বু। তবে তা একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাপড়টি স্কসটেপ দিয়ে ভালো করে এঁটে রাখলেন আব্বু, যাতে কেউ না খুলতে পারে। বললেন কেক কাটার আগ মুহূর্তে, মানে সন্ধ্যা ৭টায় কাপড়টা সরিয়ে জন্মদিন উন্মুক্ত করা হবে। কাপড় সরালেই বুঝবে কার জন্মদিন। তেমনি কেকের বাক্সটিও শক্ত করে বাঁধা। ওটাও সন্ধ্যার আগে ছাড়া খোলা বারণ। আব্বু বললেন- আজ যার জন্মদিন কেকের ওপরেও বড় বড় করে তার নাম লেখা আছে। বিকেলে কাব্য, সোজি ও আব্বু পুরো পাড়ার শিশুদের ডাকলেন। সব ছেলে-মেয়েকে আব্বু জন্মদিনের দাওয়াত করলেন। সন্ধ্যা ৭টায় কেক কাটার অনুষ্ঠান। তবে কার জন্মদিন তা না বলে সবাইকে জানিয়ে দিলেন কেউ কোনো উপহার নিয়ে আসতে পারবে না। এতে পাড়ার ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও কৌতূহল জাগল। একেকজন একেক মন্তব্য করে। রহস্যের গোলকধাঁধায় আটকে গেল সবাই। সন্ধ্যার আগেভাগেই পাড়ার ছেলে-মেয়েরা হাজির হলো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। ডাইনিং রুমে কয়েকটি পাটি পেতে দিলেন আব্বু। সবাই গোল হয়ে বসল। সবার চোখ দেয়ালে। তারা অধীর আগ্রহে বসে আছে। ওই কাপড়টা সরালেই বোঝা যাবে কার জন্মদিন আজ। এবার ৫ পাউন্ড ওজনের কেকটা এনে একটা টি-টেবিলের ওপর রাখলেন আব্বু। রসগোল্লার প্যাকেটগুলোও সামনে আনলেন। একটি ছুরি আনলেন কেক কাটার জন্য। গুনে গুনে ৫৮টি মোমবাতি সাজালেন টি-টেবিলে। ৫৮টি মোমবাতি কেন? সবার মধ্যে নতুন আরেক কৌতূহল। এবার আব্বু সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেয়ালের কাপড়টি সরিয়ে ফেলা হবে। এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য ওই কাপড়টা সরিয়ে জন্মদিন উন্মুক্ত করবে।’ কে সবচেয়ে ছোট? সবাই বুঝল সোজি। সোজি কাব্য’র একমাত্র বোন। ওর বয়স ৫ বছর। ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ৭টা বাজতে আর মাত্র এক মিনিট বাকি। সোজিকে কোলে তুলে নিলেন আব্বু । ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দেয়ালের পাশে। উপস্থিত কচি-কাঁচারা একদম চুপ। এবার আব্বু সোজিকে বললেন দু’হাত দিয়ে কাপড়টা সরাও। সোজি তার তুলতুলে দু’হাত দিয়ে আস্তে আস্তে কাপড়টা সরিয়ে দিল। পুরো ডাইনিং রুম করতালি আর হইচইয়ে মুখর হয়ে উঠল। সবাই দেখল সেখানে লেখা আছে ‘শেখ রাসেলের ৫৫তম শুভ জন্মদিন আজ।’ (০৭.১০.২০১৮) দৈনিক খোলা কাগজের ইচ্ছেডানা পাতায় (১৬.১০.২০২১) প্রাকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন